শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:২০ পূর্বাহ্ন
আব্দুল্লাহ আল রাহাত:
বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বকালের সেরা মহামানব ও মানবজাতির জন্য উত্তম ও পরিপূর্ণ আদর্শ। পবিত্র কোরআনে তাকে সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য আল্লাহর রহমত বা অনুগ্রহ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি ছিলেন একজন সর্বোত্তম গণমুখী চরিত্রের অধিকারী ও মানবপ্রেমিক। আসমান ও জমিনে এমন মহামানব দ্বিতীয় কেউ আসেননি আর আসবেনও না। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশ্বমানবকে আঁধার ঘেরা পথ থেকে আলোর পথে আহ্বান করতে তার প্রিয় বন্ধুর অনুপম চরিত্রকে আলোকবর্তিকা স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন। তিনি তাকে ধরণির জন্য শান্তিস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। আর এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর কাছে রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ১০৭) এই মহামানবের আত্মা যাবতীয় উত্তম স্বভাব-প্রকৃতি এবং মূল্যবান বৈশিষ্ট্য, কর্ম ও যোগ্যতার আলোয় আলোকিত ছিল। তার চরিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘অবশ্যই আল্লাহর রাসুলের মাঝে তোমাদের জন্য রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব : ২১)
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করে, তিনি পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠতর স্বভাব-চরিত্রের অতুলনীয় আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। মহানুভবতা রাসুল (সা.)-এর সুন্দর চরিত্রের মহান একটি দিক। আল্লাহতায়ালা তার অন্তরে এত বেশি উদারতা, মহানুভবতা দান করেছেন, যেন তার হৃদয় মহানুভবতার এক মহাসাগর। মহানবী (সা.)-এর হৃদয় ছিল আকাশের মতো সুবিশাল। তিনি কখনো কারও প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করতেন না। তার কথাবার্তা, কাজকর্ম, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, লেনদেন ইত্যাদি সবকিছু ছিল স্বচ্ছ, সাবলীল ও উদার। তর হৃদয়ের মধ্যে কোনো ধরনের কাঠিন্যভাব ছিল না। আর এই বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে ‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয়ের অধিকারী হয়েছেন পক্ষান্তরে যদি আপনি রাগ ও কঠিন হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত।’ (সুরা আল-ইমরান : ১৫৯)
মহানবী (সা.) তার চরম শত্রুকেও ক্ষমা করতে কার্পণ্যবোধ করতেন না। মুতার যুদ্ধে রওনার প্রাক্কালে তিনি সাহাবিদের নারী, শিশু এবং অক্ষম বৃদ্ধাকে হত্যা না করতে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। আবার প্রিয়ভাজন ব্যক্তির অন্যায়কেও তিনি কখনো প্রশ্রয় দিতেন না। আরবের সব মানুষের জন্য তিনি ছিলেন নিরাপদ আশ্রয়। তার এই অনুপম মহানুভবতার জালে পুরো আরবের প্রতিটি মানুষ আবদ্ধ ছিল।
হেরা গুহায় ধ্যানরত অবস্থায় হজরত জিবরাইল (আ.) অহি নিয়ে আগমন করার পর রাসুল (সা.) ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় অহি নিয়ে ঘরে ফিরলে, হজরত খাদিজা (রা.) তাকে অভয় দিয়ে বলেন, ‘আল্লাহর কসম! কখনোই না, আল্লাহ আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। নিশ্চয়ই আপনি তো আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, অসহায়দের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, নিঃস্বকে উপার্জন করে দেন, মেহমানদের উত্তমরূপে মেহমানদারি করেন এবং সত্যের বিপদে সহায়তা করেন।’ (বুখারি, হাদিস নম্বর : ৩)
আরবের মধ্যে অনেক আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন বংশে লালিত-পালিত হওয়ার পরও তিনি কখনো মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও হেয়প্রতিপন্ন করেননি বা নগণ্য ভাবেননি। তার সমগ্র জীবনটাই ছিল বিস্ময়কর মহানুভবতার জীবন। রাসুল (সা.)-এর মহানুভবতার সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হলো, দীর্ঘ দশ বছরের খাদেম হজরত আনাস (রা.)-এর সঙ্গে তার কোমল আচরণ। যার কোমল পরশ ও স্নিগ্ধতা আনাস (রা.) দশ বছর ধরে উপভোগ করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি নিজেই বলেন, ‘আমি দীর্ঘ দশ বছর রাসুল (সা.)-এর খেদমত করেছি। তিনি কখনো আমাকে উফ্ফ শব্দটিও বলেননি। এমনকি এ কথাও বলেননি যে, তোমার দ্বারা এ কাজটি সম্পন্ন হয়নি অথবা তুমি কি কাজটি করোনি।’ (বুখারি, হাদিস নম্বর : ৫৬৯১)
তিনি দুর্বল, অসহায় ও অধিকার বঞ্চিত দাস-দাসীদের প্রতি ন্যায়সংগত বিচার ও তাদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে জোর তাকিদ দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয় মহানবী (সা.) শিশুদের খুব ভালোবাসতেন এবং স্নেহ করতেন। তিনি তাদের চুম্বন করতেন এবং নিজ মুখে খেজুর খাইয়ে দিতেন। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর কাছে দুধের শিশুকে নিয়ে আসা হলো, অতঃপর শিশুটি তার কোলে পেশাব করে দিল। তিনি পানি নিয়ে আসার জন্য বললেন এবং তাতে পানি ঢেলে দিলেন।’ (বুখারি, হাদিস নম্বর : ৬৮৯)
চতুষ্পদ জন্তুর প্রতি তার ছিল অত্যধিক মমতা। আবার নি®প্রাণ জড় পদার্থের প্রতিও তার হৃদয় ছিল অনেক প্রশস্ত। এ কারণেই মসজিদে নববিতে ক্রন্দনরত খেজুরগাছের খ-ে হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। তার মহানুভবতা ও উদারতার অনন্য এক দৃষ্টান্ত হলো, মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে মক্কার কাফেরদের প্রতি তার ক্ষমাশীলতা। যাদের দ্বারা রাসুল (সা.) কষ্টে জর্জরিত হয়েছেন, তাদের হাতের নাগালে পেয়েও প্রতিশোধ গ্রহণ না করে তাদের বিনম্র আচরণ উপহার দিয়েছিলেন। তার এই কোমলতা পবিত্র কোরআনের ভাষায় : ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সব দয়াবানের চেয়েও অধিক দয়ালু।’ (সুরা ইউসুফ : ৯২)
আর এই অতুলনীয় দৃষ্টান্ত উপস্থাপনের মাধ্যমেই তিনি পুরো আরবজাতিকে খুব অল্প সময়ে ইসলামের ছায়াতলে একত্র করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাসুল (সা.)-এর নম্রতা ও মহানুভবতার মধ্যে রয়েছে মানবজাতির মুক্তির শিক্ষা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, আজও এ মহান শিক্ষাকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারলে সর্বত্র শান্তির সুবাতাস বইবে, ইনশাআল্লাহ।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া